অচেনা বন্ধু – সুস্মিতা দে হাজরা
Updated: Aug 8, 2019
রাত সাড়ে এগারোটা। বন্দীপুরের প্লাটফর্মটা প্রায় পুরোটাই ফাঁকা। এত রাত হয় না আমার। আর হলেও সঙ্গে গাড়ি থাকে। আর আজ শীতের এই রাতেই গাড়িটা সঙ্গে নেই! প্ল্যাটফর্মে কয়েকজন মানুষ ছন্নছাড়া হয়ে এখানে সেখানে বসে রয়েছে । সবাইকে বেশ নিশ্চিন্তই দেখাচ্ছে। আমি ছাড়া আর কারোর চিন্তার কোন কারণ আছে বলে মনে হয় না। সবাই সারা দিনের পরিশ্রমের পর ক্লান্ত হয়ে শেষ ট্রেনের অপেক্ষায়। আর আমি বিপদের অপেক্ষায়!

একজন ক্রিমিনাল ল'ইয়ার আমি। আর শহর কাঁপানো এই রেপ কেসটা হাতে নেবার পর থেকে বিপদ আমার নিত্যসঙ্গী। প্রথম প্রথম আঘাত আসতো সামনে থেকেই। কিন্তু আজকাল আঘাতের চরিত্র বদলেছে। অপরাধী রাজ্যের প্রধান বিরোধী দলের প্রথম সারির নেতার পরমাত্মীয় যে।
আমার যে আজ রাত হবে সেটা অনুমান করা আমার উচিত ছিল। এই কেসটা নেওয়ার পর থেকে মা তো প্রায় পাগলের মতো করছে । তার আদরের তুতুনকে টিভিতে এতবার দেখে আনন্দের সাথে অস্বস্তিতেও পড়েছে বেচারা। আমার বিপদ কতদুর সেটা আন্দাজ করতে পারছে না বলে আরো অসহায় হয়ে পড়েছে। এখনও পর্যন্ত অনেকবার ফোন হয়ে গেছে। শেষে মিথ্যাই বলতে হল। আমাকে গাড়ি করে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে এটাই বললাম।
প্ল্য়াটফর্মে আমার পাশের বেঞ্চে দুটো লোক বসে। দু'জনায় ব্যাস্ত মোবাইলে। শীতের রাতে মুখ পুরো ঢাকা মাফলারে। আমার অস্বস্তি আরো বাড়ছে এবার। আজ ভিক্টিমের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম। আমার তো বোঝা উচিত ছিল আজ দেরী হবেই। মোবাইলে টুং টাং আওয়াজ। একটা নম্বর থেকে হোয়াটসঅ্যাপ ঢুকলো। ভালো করে দেখে বুঝলাম নম্বরটা রন্টুদার। পাড়ার মস্তান। ছোটবেলা থেকেই দেখছি। একটা কারণে নম্বরটা দিতে হয়েছিল।
রন্টুদা লিখেছে, “কি রে তুতুন কেমন আছিস?” এত রাতে ম্যাসেজ! আমার উপর ওর ক্রাস ছিল সেই ছোট বেলাতেই। বিরক্ত লাগছে এবার। এখন থেকে কি এসব চুনো পুঁটিগুলোও আমাকে ভয় দেখাবে? আবার টুংটাং। “খুব তো নামডাক শুনছি তোর। একটু সাবধানে চলাফেরা করিস।” অন্য সময় হলে ফোন করেই এর ফয়সলা করতাম। কিন্তু এখন যেন ভয়টা আরো বেশি জড়িয়ে ধরছে আমায়। যতটা সাহস নিয়ে কেসটা নিয়েছিলাম, এখন প্রতিপক্ষ আমার সেই মনবল ভাঙতে কোন কসুর করছে না।
ট্রেনটা এখনও আসছে না। লেট নাকি? কিন্তু প্ল্য়াটফর্মের ওপাশে একদল ছেলে! এদিকেই তো আসছে। আমার দিকে আসছে কি? হ্যাঁ, আমাকেই তো দেখছে! কি করবো এবার। সহযাত্রীদের কাছে কোনও সাহায্য পাবো বলে তো মনে হচ্ছে না। কে ঝামেলায় পড়তে চাইবে এতোগুলো মস্তানের সাথে। নাহ্, এখুনি কিছু করতে হবে। টিকিট কাউন্টারের দিকে ছুট লাগালাম। ওখানে রেলের আরো লোকজন থাকবে নিশ্চয়ই। পুলিশে খবর দিতেই হবে।
কিন্তু পিছনে কারা যেন মারপিট করছে। থামতে বাধ্য হলাম তাই। ওই মস্তানগুলোকে আমার পাশের বেঞ্চে বসা মুখঢাকা লোকটা খুব পেটাচ্ছে। গায়ে কি শক্তি লোকটার! এতোগুলো ছেলেকে নাকানিচুবানি খাওয়াচ্ছে। এবার মনে হচ্ছে বন্দুক বার করেছে। পালাচ্ছে ছেলেগুলো। প্ল্য়াটফর্মের বাকিরাও পালাচ্ছে বিপদের আশঙ্কা করে। শুধু আমি দাঁড়িয়ে হাঁপাচ্ছি। আমার দিকে ঘুরলো লোকটা। ওর মুখটা এখন দেখা যাচ্ছে। আমার দিকে জোর কদমে এগিয়ে আসছে। একি! রন্টুদা! কাছে এসেই খুব জোর ধমক লাগালো। গাড়ি নিয়ে বেড়োইনি কেন জানতে চাইলো। আরো কত কিছু বলছিল ও। আমার আর কানে আসছিলো না কিছু। পায়ে আর জোর পাচ্ছি না। পড়ে যাবার আগেই ধরে ফেললো রন্টুদা। বসিয়ে দিল প্ল্য়াটফর্মের বেঞ্চে।
একটু ধাতস্থ হবার পর আমার প্রশ্নটা আন্দাজ করেই রন্টুদা বললো, “তুতুন, তোর মতো ভালো মেয়েরা চিরকাল সমাজের নোংরা পরিস্কার করে নিজেদের কর্তব্য করবে এটাই স্বাভাবিক। আর আমার মতো সমাজের জঞ্জালেরা কি করবে জানিস? তোদেরকে ভদ্র মুখোশধারীদের হাত থেকে বাঁচাবে।” “হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমি এজন্য টাকা অবশ্যই পাবো। তোর ভাগ্য ভালো যে শাষকদলের নেক নজর আছে তোর উপর। তাই তো তোকে চব্বিশ ঘণ্টা পাহারা দেওয়া আমার কাজ।” বলেই হো হো করে হেসে উঠলো সে। “তোর দুর্ভাগ্য তুতুন। আমাকে তুই কত অপছন্দ করিস তা তো আমি জানিই। কিন্তু দেখ্, তুই এখন আমারই চোখের সামনে থাকবি সবসময়। না চাইলেও কিছুই করার নেই তোর। আমিই তোর সখা, আমিই তোর বন্ধু, আমিই তোর শ্রীকৃষ্ণ।”
দমফাটা হাসিতে সারা প্ল্য়াটফর্ম কাঁপছে। আমার ভিতরেও সেই কম্পন অনুভূত হচ্ছে। ভক্ষক যদি কখনো রক্ষক হয়ে ওঠে তখন কি এমনই অনুভুতি হয়?